ভারতীয় সভ্যতার মূল ভিত্তি হলো বৈদিক জ্ঞান।
এটি কেবলমাত্র প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ নয়, বরং একটি জীবনদর্শন, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন দিক নির্দেশ করে। প্রফেসর কাইলাশ চতুর্বেদী, যিনি ৮৬ বছর বয়সে এখনও বৈদিক জ্ঞান ও তার প্রাসঙ্গিকতার ওপর কাজ করছেন, তার চিন্তাভাবনার মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পারি, এই জ্ঞানের গভীর তাৎপর্য।
বেদ: আদি জ্ঞানের উৎস
প্রফেসর চতুর্বেদী বেদের চার ভাগ—ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ববেদ—এবং তাদের আলাদা আলাদা ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ঋগ্বেদ আমাদের ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগ ঘটানোর পদ্ধতি শেখায়। এটি মূলত প্রার্থনা এবং জ্ঞানের প্রকাশ। যজুর্বেদ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্মের নিয়মকানুন শেখায়। পূজার আচার, যজ্ঞ এবং অন্যান্য ধর্মীয় কার্যকলাপ এর অন্তর্ভুক্ত। সামবেদ সংগীত এবং সৃষ্টির সৌন্দর্যের প্রতি উৎসর্গীকৃত। এটি মানুষকে আধ্যাত্মিক সংগীতের মাধ্যমে আনন্দিত করে। অথর্ববেদ আমাদের স্বাস্থ্য, চিকিৎসা এবং দৈনন্দিন জীবনের সমস্যার সমাধান দেয়।
পঞ্চভূত: মানুষের শরীর ও প্রকৃতির সংযোগ
বৈদিক দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো পঞ্চভূতের ধারণা। প্রফেসর চতুর্বেদী বলেন, জল, বায়ু, অগ্নি, পৃথিবী এবং আকাশ এই পাঁচটি উপাদান মানবশরীর এবং প্রকৃতির মধ্যে গভীর সংযোগ স্থাপন করে। উদাহরণস্বরূপ, তিনি ব্যাখ্যা করেন যে মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশ এই পঞ্চভূতের প্রতিনিধিত্ব করে। এই ধারণা আমাদের শেখায় কীভাবে প্রকৃতির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে হয়।
মানবজীবনের চারটি স্তর
প্রফেসর চতুর্বেদী বৈদিক জীবনের চারটি স্তর ব্যাখ্যা করেছেন। এই স্তরগুলো হলো—ব্রহ্মচার্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ, এবং সন্ন্যাস। ব্রহ্মচার্য হলো শিক্ষার সময়, যখন একজন ছাত্র জ্ঞান অর্জন করে এবং আত্মশক্তি গড়ে তোলে। গার্হস্থ্য হলো পরিবার ও সমাজের জন্য দায়িত্ব পালন। বানপ্রস্থ হলো আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনা এবং সৃষ্টিকর্তার প্রতি নিবেদন। সন্ন্যাস হলো চূড়ান্ত মুক্তি এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের পথ।
‘ওঁ’: সৃষ্টির আদি শব্দ
‘ওঁ’ শব্দটি বৈদিক দর্শনের মূলমন্ত্র। এটি সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয়ের প্রতীক। প্রফেসর চতুর্বেদী বলেন, “ওঁ শব্দটি সঠিকভাবে উচ্চারণ করলে মানুষের মনের মধ্যে এক ধরনের শক্তি সৃষ্টি হয়। এটি মানুষের সমস্ত নেতিবাচকতা দূর করে এবং তাকে নতুন উদ্যমে কাজ করার অনুপ্রেরণা দেয়।” তিনি আরও উল্লেখ করেন যে ‘ওঁ’ শব্দটি ঈশ্বরের উপস্থিতির প্রতীক এবং এটি সমস্ত জ্ঞানের মূল।
আধুনিক যুগে বৈদিক জ্ঞানের প্রাসঙ্গিকতা
বৈদিক জ্ঞানকে অনেকেই প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেন। কিন্তু প্রফেসর চতুর্বেদী দেখিয়েছেন, এটি আধুনিক যুগেও কতটা প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেন, বৈদিক জ্ঞানের মূল শিক্ষা হলো প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের ভারসাম্য রক্ষা। এটি আমাদের শিখায় কীভাবে সহজ এবং সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করতে হয়।
ঋষিদের অবদান এবং তাদের জীবনধারা
বৈদিক যুগের ঋষিরা আমাদের জন্য এক অনন্য জীবনধারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারা কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক দিক থেকেই নয়, বৈজ্ঞানিক দিক থেকেও মানুষকে অগ্রসর হতে সাহায্য করেছিলেন। প্রফেসর চতুর্বেদী উল্লেখ করেছেন যে ঋগ্বেদের সূচনা মন্ত্রগুলো কেবল ঈশ্বরের বন্দনা নয়, বরং সৃষ্টির বিজ্ঞান। তিনি বলেন, “ঋষিরা আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে প্রকৃতিকে বুঝে তার সঙ্গে মিলেমিশে জীবনযাপন করতে হয়।”
বৈদিক জ্ঞান এবং সামাজিক কাঠামো
অথর্ববেদে উল্লেখ রয়েছে কীভাবে একটি সমাজের কাঠামো গঠন করতে হয়। এটি আমাদের শিখায় কীভাবে একটি সুশৃঙ্খল এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন করা যায়। প্রফেসর চতুর্বেদী বলেন, “বৈদিক দর্শন কেবল ধর্মীয় আচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোতেও প্রভাব ফেলে।”
সংগীত ও সামবেদ
সামবেদ মূলত সংগীতের প্রতি উৎসর্গীকৃত। এটি বৈদিক যুগের সংগীতের প্রাথমিক উৎস। প্রফেসর চতুর্বেদী বলেন, “সংগীত মানুষের মনের গভীর আনন্দের উৎস। সামবেদ আমাদের শেখায় কীভাবে সংগীতের মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানো যায়।”
উপসংহার: বৈদিক জ্ঞান আমাদের উত্তরাধিকার
প্রফেসর চতুর্বেদীর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে বৈদিক জ্ঞান কেবল প্রাচীন ঐতিহ্য নয়, এটি আমাদের জীবনের মূল স্তম্ভ। এটি আমাদের আত্মার শক্তি বৃদ্ধি করে, আমাদের মনের শান্তি দেয় এবং আমাদের একটি উন্নত জীবনের দিকে নিয়ে যায়। আজকের সমাজে, যেখানে মানুষ প্রতিনিয়ত মানসিক চাপের মুখোমুখি হচ্ছে, বৈদিক জ্ঞান হতে পারে এক কার্যকরী সমাধান।
Leave a Reply