কুপিয়ে হত্যা চেষ্টা ও নারীর শ্লিলতাহানির চিত্র এবং মামলার কয়েকজন আসামি।। ফাইল ছবি

চাঁদপুর জেলার হাইমচর থানার চরপোড়ামুখী গ্রাম ও আশপাশের এলাকা যেন হয়ে উঠেছে অপরাধের স্বর্গরাজ্য। সাবেক ইউপি মেম্বার ইসমাইল কাজীসহ তার পারিবারিক গ্যাংয়ের কাছে জিম্মি হয়ে রয়েছে ওই উপজেলার সাধারণ মানুষ।

রহস্যজনক কারণে তাদের পেশিশক্তির কাছে যেন বারবার হার মেনে যাচ্ছে ওই এলাকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পরিবারটির অন্যায়-অপরাধ ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কেউ মুখ খুললে ঝড়ের মতো হামলা চলে প্রতিবাদ করা ওইসব মানুষের ওপর। পুরো এলাকার মানুষ আজ তাদের কাছে অসহায়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও থানা পুলিশও যেন মেম্বার পরিবারটির কাছে লজ্জাবতী গাছের পাতা। ছোঁয়া লাগলেই গুটিয়ে যায়!

মেম্বার পরিবারটির একেকজন সদস্যের কারও বিরুদ্ধে ৪টি, কারও বিরুদ্ধে ৩টি, আবার কারও কারও বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকলেও তারা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। নারীর শ্লীলতাহানি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, হত্যাচেষ্টা, মারধর, জোর করে জমি দখল থেকে শুরু করে যেকোনো অভিযোগ তারা নিমিষেই হজম করে ফেলে। এমনকি এতিমদের হকও মেরে খেতে তারা দ্বিধাবোধ করে না।

ইতোমধ্যে এই পরিবারটির বিষয়ে বিস্তর অনুসন্ধান চালিয়েছে আরটিভি নিউজ। তাদের বিরুদ্ধে অন্তত ৫টি মামলার নথি রয়েছে আরটিভি নিউজের হাতে।

১ম মামলা: সিসি ক্যামেরা ভাঙচুর করে নারীর শ্লীলতাহানি হত্যার উদ্দেশ্যে ছেনির কোপ

সর্বশেষ চলতি মাসে (গত ৩ এবং ৪ মার্চ) পরপর দুই দিন হাইমচরের চরপোড়ামুখী গ্রামের সফিউল্যা ও তার পরিবারের ওপর হামলা চালায় মেম্বার পরিবারের গ্যাংয়ের সদস্যরা। এ সময় সফিউল্যার স্ত্রী কামরুন নাহার বেগম ও তার পুত্রবধূ নাজমা বেগমের শ্লীলতাহানি করার পাশাপাশি শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। একই সঙ্গে সফিউল্যাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার মাথায় ধারালো ছেনি দিয়ে বেপরোয়াভাবে কোপ দেওয়া হয়। যে কারণে তার মাথায় ৪টি সেলাই লেগেছে। এ ছাড়াও সফিউল্যার ছেলে জয়নাল আবেদীনকে বেধড়ক মারধর করে ইসমাইল মেম্বারের বড় ভাগ্নে শান্ত খান ও ছোট ভাগ্নে রাতুল খান, তাদের বাবা শাহজাহান খান ও সালেহা বেগমসহ অন্যরা। আর এসব ঘটনার নেতৃত্ব দেয় সাবেক ইউপি মেম্বার ইসমাইল কাজী। সংশ্লিষ্ট ঘটনার ভিডিও চিত্র এবং সিসি ক্যামেরার ফুটেজ আরটিভি নিউজের হাতে রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই ঘটনায় প্রথম দিকে মামলা নিতে অনীহা প্রকাশ করে হাইমচর থানা পুলিশ। পরে সফিউল্যার ছেলে জয়নাল আবেদীন চাঁদপুরের আদালতে বাদী হয়ে অভিযোগ দাখিল করলে সেটিকে এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করতে থানা পুলিশকে নির্দেশ দেন বিচারক। সেই অনুযায়ী এই ঘটনায় (সিআর মামলা নং-২৮-২২) এবং (জিআর মামলা নং-৬-২৯) দায়ের হয়। একই সঙ্গে ঘটনাটি চট্টগ্রামের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন এবং চাঁদপুরের এসপি মিলন মাহমুদকে জানালে তারা যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।

হামলার শিকার সফিউল্যা চাঁদপুর সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এখন বাড়িতে বিশ্রামে রয়েছেন। মেম্বার পরিবারের হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে ভুক্তভোগীর ছেলে সংশ্লিষ্ট মামলার বাদী জয়নাল আবেদীন বলেন, মেম্বার পরিবার চাঁদাবাজি, ছিনতাই, জমি দখল থেকে শুরু করে যেকোনো অপরাধ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। কথায় কথায় মেরে লাশ গুম করে ফেলার হুমকি দেয় তারা।

এই অসাধু পারিবারিক গ্যাংয়ের অন্যতম হোতা সদ্য সাবেক ইউপি মেম্বার ইসমাইল হোসেন কাজী। আর বর্তমান ইউপি মেম্বার মাহবুব কাজী ইসমাইলেরই ভাতিজা।

শোনা যাচ্ছে, বর্তমান ইউপি মেম্বার মাহবুব কাজীও তার স্বজনদের অপকর্মের পেছনে ইন্ধন দেন। ইসমাইলের বোন সালেহা বেগম ও শাহজাহান আমাদের কাছ থেকে সামান্য জায়গা কিনে এখন আমাদের পারিবারিক পুরো জায়গা জোর করে ভোগদখল করতে চাচ্ছে। সেই উদ্দেশ্যেই তারা আমাদেরকে পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে চলে যেতে পেশিশক্তি প্রয়োগ করছে। গত ৩ এবং ৪ মার্চ আমার বাবাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপ দেয়, আমার মা এবং আমার স্ত্রীর শ্লীলতাহানি করে, পাশাপাশি আমার ওপরও হামলা চালায়। এ ছাড়াও এই ঘটনার সময়ে প্রতিবেশী যে বা যারা আমাদেরকে উদ্ধারে এগিয়ে এসেছিল তাদের ওপর হামলা চালায় মেম্বার পরিবারের গ্যাংয়ের সদস্যরা।

জয়নাল আবেদীন আরও জানান, বেপরোয়া হামলা ও অন্যান্য অপরাধের প্রমাণ মুছে ফেলতে তারা আমার ঘরের আশপাশের সিসি ক্যামেরায় ভাঙচুর চালায়। এই ভাঙচুর চালানোর আগে মূহুর্তের ভিডিওচিত্র রয়েছে আমার কাছে।

গতকাল রোববার (১৩ মার্চ) তারা চাঁদপুর সদরে আদালতের কাছেই একটি সড়কে আমাকে মামলা তুলে নিতে হুমকি-ধমকি দেয়। অন্যথায় আমাকে বা পরিবারের যে কাউকে হত্যা করবে বলে জানায়। যে কারণে আমি গতকালই চাঁদপুর সদর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি করি। মামলা দায়ের হওয়ার পর আসামিরা প্রকাশ্যে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, অথচ পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করছে না। এমন পরিস্থিতিতে আমি ও আমার পরিবার মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছি। তাই, যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটার আগেই রাষ্ট্রের আইন ও বিচার বিভাগের সংশ্লিষ্টদের কাছে আমি এ বিষয়ে সহায়তা চাচ্ছি।

এই মামলায় ৮ জনকে এজহারানামীয় আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন- শান্ত খান, সালেহা বেগম, শাহজাহান খান, রাতুল খান, রাকিব কাজী, ইসমাইল কাজী, রাসেল কাজী, আহসান কাজী। এ ছাড়াও অজ্ঞাতনামা ২-৩ জনকে আসামি করা হয়েছে।

২য় মামলা : ছিনতাই হত্যাচেষ্টা মামলা

ঘটনাটি ২০২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকের। যে ঘটনায় চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি হাইমচর থানায় মামলা দায়ের করা হয়। মনির হোসেন মোল্লা নামের এক ব্যবসায়ীকে মারধর ও হত্যার চেষ্টা চালায় সাবেক ইউপি মেম্বার ইসমাইল গ্যাংয়ের ছোট ভাই রফিক কাজী। ঘটনায় বাবার সঙ্গে যুক্ত হয় রফিক কাজীর ছেলে রাকিব কাজীও। বাবা-ছেলে দু’জন মিলে মনির মোল্লাকে হত্যাচেষ্টা চালালেও আশপাশের লোকজনের সহায়তায় প্রাণে বেঁচে যান। তবে ওই সময়ে মনিরের গলায় থাকা স্বর্ণের চেন ও মোবাইল ফোন সেট ছিনিয়ে নিয়ে যায় হামলাকারীরা। এই ঘটনায় মনির হোসেন মোল্লা হাইমচর থানায় মামলা দায়ের করেন (মামলা নং-১৩-২২)।

৩য় মামলা: এতিমখানার ওপর জুলুম হামলার শিকার উপদেষ্টা

চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি ‘চরপোড়ামুখী নূরানী মাদরাসা ও এতিমখানার’ উপদেষ্টা খাজা আহাম্মদ হাজীর ওপর প্রকাশ্যে হামলা চালায় ইসমাইল মেম্বারের পারিবারিক গ্যাং বাহিনীর সদস্যরা। ওই সময়ে খাজা আহাম্মদকে হত্যার চেষ্টা চালানো হয় বলে মামলার অভিযোগ থেকে জানা গেছে।

ভুক্তভোগীর ছেলে আকিব আহম্মেদ এ ঘটনায় বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। যার (সিআর মামলা নং-৪৯/২২) এবং (জিআর নং-৮/২২)। যেটি তদন্ত করে ইতোমধ্যে আদালতে চার্জশিট জামা দিয়েছে পুলিশ।

মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, প্রতি বছরের মতো এ বছরও জানুয়ারির ১০ তারিখ ওই মাদরাসায় ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন হওয়ার কথা ছিল। সেই আয়োজনের আয়োজক কমিটিতে ইসমাইল মেম্বারের ভাই আহসান কাজীকে না রাখায় গ্যাংয়ের সদস্যরা খাজা আহাম্মদের ওপর হামলা চালিয়ের হত্যার চেষ্টা করে।

সংশ্লিষ্ট মামলায় ৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন- ফরিদ কাজী, রাসেল কাজী, রিয়াদ কাজী, আহসান কাজী, ইসমাইল কাজী, রাকিব কাজী, রফিক কাজী, নাছির কাজী এবং নাহিদ কাজীকে।

৪র্থ মামলা: নতুন হাওলাদার বাজারের ব্যবসায়ী চাঁদা না দেওয়ায় হামলা

ঘটনাটি ২০১৮ সালের। ওই বছরের ১৮ জুন নিরীহ ফার্নিচার ব্যবসায়ী জসিমের ওপর হামলা চালায় তৎকালীন ইউপি মেম্বার ইসমাইলের পারিবারিক গ্যাংয়ের সদস্যারা। যে ঘটনার নেতৃত্বে ছিলেন খোদ ইসমাইল নিজেই। চাঁদা না দেওয়া তার ওপর হামলা চালানো হয় বলে মামলার অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে। হামলার ঘটনায় ওই বছরের ২১ জুন হাইমচর থানায় চাঁদপুরের আদালতের নির্দেশে মামলা (জিআর নং-৫১-১৮) দায়ের হয়। তবে পরে জানা গেছে মেম্বারের গ্যাং বাহিনীর চাপে মামলায় সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছিল অসহায় পরিবারটি।

সংশ্লিষ্ট মামলায় ৪ জনকে আসামি করা হয়েছিল। তারা হলেন- তৎকালীন ইউপি মেম্বার ইসমাইল কাজী, তার ছেলে রাসেল কাজী, আরেক ছেলে রিয়াদ কাজী এবং মেম্বারের ভাই আহসান কাজীকে।

৫ম মামলা: তেল ব্যবসায়ীর ওপর মেম্বার গ্যাংয়ের জোরজুলুম হামলা

ঘটনাটি ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবরের। নতুন হাওলাদার বাজারের তেল ব্যবসায়ী মফিজুল ইসলাম জুয়েলের ওপর হামলা ঘটনা ঘটায় তৎকালীন ইউপি মেম্বার ইসমাইলে গ্যাং বাহিনী। যার নির্দেশ দাতা ছিলেন মেম্বার নিজেই। পাওনা টাকা চাওয়ায় জুয়েলের ওপর উল্টো হামলা চালানো হয় বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় তেল ব্যবসায়ী জুয়েল বাদী হয়ে হাইমচর থানায় মামলা (নং-৫-৩৯) দায়ের করেছিলেন।

সংশ্লিষ্ট ঘটনায় ৬ জনকে এজহারনামীয় আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন- আহসান কাজী, ফরিদ কাজী, ফয়সাল কাজী, রাসেল কাজী, নাছির কাজী, ইসমাইল কাজী।

যা বললেন পুলিশের ডিআইজি জেলা প্রশাসক

উল্লেখিত মামলা ও অভিযোগের বিষয়ে আরটিভি নিউজ কথা বলে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন এবং চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অঞ্জনা খান মজলিশের সঙ্গে।

মামলা হলেও আসামি না ধরার বিষয়টি চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজির নজরে আনলে তিনি বলেন, ‘মামলা হলে পুলিশ অবশ্যই সেটি যথাযথভাবে তদন্ত করবে এবং অভিযোগের সত্যতা পেলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। এতে অপরাধী যতোই প্রভাবশালী হোক তাদেরকে বিন্দু পরিমাণও ছাড় দেওয়া হবে না।’

জেলা পর্যায়ের স্থানীয় প্রশাসনের প্রধান হিসেবে দায়িত্বপালকারী চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, ‘স্থানীয় প্রশাসনের আওতায় যে বা যারা দায়িত্ব পালন করছেন। তারা কোনো অন্যায় অপরাধ করে ছাড় পাওয়ার সুযোগ নেই। তাই সংশ্লিষ্ট ইউপি মেম্বারের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’